গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম: ভূমিকা-
গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরে নানা রকম শারীরিক ও হরমোনগত পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম। এই সমস্যায় অনেক সময় হাত ও আঙুলে ঝিনঝিনি, অবশভাব, ব্যথা এবং দুর্বলতা দেখা যায়।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব—গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম কী, কেন হয়, এর লক্ষণ, প্রতিকার, চিকিৎসা এবং যত্নের উপায়।
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম কী?-
কার্পাল টানেল সিনড্রোম হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে কবজির ভেতরে থাকা মিডিয়ান নার্ভ-এ চাপ পড়ে। এই নার্ভটি হাত ও আঙুলের নড়াচড়া ও অনুভূতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় শরীরে তরল জমে গিয়ে কবজির চারপাশে ফোলা তৈরি করে, যা নার্ভকে চাপ দেয় এবং এর ফলে কার্পাল টানেল সিনড্রোম হয়।
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম হওয়ার কারণ-
- হরমোন পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন বেড়ে যায়, যা শরীরে পানি জমতে সহায়তা করে। - শরীরে তরল জমা (Fluid Retention)
গর্ভাবস্থায় হাত, পা ও কবজিতে ফোলা হয়, যা মিডিয়ান নার্ভে চাপ ফেলে। - ওজন বৃদ্ধি
হঠাৎ ওজন বেড়ে গেলে কবজির নার্ভের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। - রক্তসঞ্চালনের পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় রক্ত প্রবাহ ও সঞ্চালনে পরিবর্তন হয়, যা কবজির নার্ভে প্রভাব ফেলতে পারে। - অতিরিক্ত হাত ব্যবহার
রান্না, লেখালেখি, কম্পিউটারে কাজ করা বা ভারী জিনিস তোলার ফলে সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোমের লক্ষণ-
- আঙুলে ঝিনঝিনি বা অবশভাব (বিশেষ করে বুড়ো আঙুল, তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকায়)
- হাত বা কবজিতে ব্যথা
- রাতে ঘুমানোর সময় হাত অবশ হয়ে যাওয়া
- হঠাৎ বস্তু হাত থেকে পড়ে যাওয়া
- আঙুল নড়াচড়ায় অসুবিধা
- কবজি ফুলে যাওয়া
কার্পাল টানেল সিনড্রোম কখন বেশি হয়?-
গর্ভাবস্থার শেষের দিকে (তৃতীয় ট্রাইমেস্টার) এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। তবে কিছু নারীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারেই শুরু হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোমের ঝুঁকি-
- যাদের গর্ভাবস্থার আগে থেকেই ডায়াবেটিস, থাইরয়েড সমস্যা বা আর্থ্রাইটিস আছে
- যারা অতিরিক্ত কম্পিউটার বা হাতের কাজ করেন
- গর্ভাবস্থায় যাদের শরীর অনেক বেশি ফুলে যায়
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোমের প্রতিকার-
১. হাত বিশ্রাম দেওয়া
বারবার একই ধরণের হাতের কাজ এড়িয়ে চলা উচিত।
২. কবজি সোজা রাখা
হাতের ভঙ্গি ঠিক রাখতে কবজি স্প্লিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. ঠান্ডা সেঁক
কবজিতে বরফ সেঁক দিলে ব্যথা ও ফোলা কমে।
৪. হাত উঁচু করে রাখা
ঘুমানোর সময় বা বিশ্রামে হাত বালিশের ওপর উঁচু করে রাখতে হবে।
৫. হালকা ব্যায়াম
কবজির হালকা ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে।
৬. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
- অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলা
- ভিটামিন বি৬ সমৃদ্ধ খাবার (ডিম, কলা, মাছ, বাদাম) খাওয়া
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোমের চিকিৎসা-
- ডাক্তারি পরামর্শ: অবস্থা গুরুতর হলে চিকিৎসক ওষুধ বা বিশেষ চিকিৎসা দিতে পারেন।
- ফিজিওথেরাপি: কবজির বিশেষ ব্যায়াম ও ফিজিওথেরাপি ব্যথা উপশমে সহায়ক।
- সার্জারি: খুবই গুরুতর ক্ষেত্রে (যা গর্ভাবস্থার পরও থেকে যায়) অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে গর্ভাবস্থায় সাধারণত অস্ত্রোপচার করা হয় না।
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম প্রতিরোধে করণীয়-
- দীর্ঘসময় মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার এড়িয়ে চলা
- হাত ও কবজি বিশ্রামে রাখা
- পর্যাপ্ত পানি পান করা
- হালকা ব্যায়াম করা
- গর্ভাবস্থায় ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
ঘরোয়া উপায়ে গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোমের যত্ন-
- গরম পানিতে হাত ভিজিয়ে রাখা
- কবজিতে হালকা মাসাজ করা
- আদা চা বা হলুদ দুধ খেলে প্রদাহ কমতে পারে
- রাতে কবজিতে নরম কাপড় দিয়ে হালকা চাপ দিয়ে বেঁধে রাখা
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?-
- ব্যথা এতটাই বেশি যে স্বাভাবিক কাজ করতে অসুবিধা হয়
- আঙুল সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যায়
- হাতের শক্তি কমে যায় এবং জিনিস ধরতে কষ্ট হয়
- হাতের ব্যথা ও ফোলা দিন দিন বেড়ে যায়
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি অনেক সময় মা’কে মানসিক ও শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়। তবে সঠিক যত্ন, খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে সহজেই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। গর্ভাবস্থার পর সাধারণত উপসর্গ নিজে থেকেই সেরে যায়।
গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম কি বিপজ্জনক?
উত্তর: সাধারণত বিপজ্জনক নয়, তবে এটি অস্বস্তি ও ব্যথা সৃষ্টি করে। গুরুতর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থার পর কার্পাল টানেল সিনড্রোম কি চলে যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের পর ফোলা কমে যায় এবং উপসর্গ চলে যায়।
প্রশ্ন ৩: ঘরে বসে কিভাবে কার্পাল টানেল সিনড্রোম নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
উত্তর: কবজি সোজা রাখা, হাত উঁচু করে রাখা, ঠান্ডা সেঁক দেওয়া এবং হালকা ব্যায়াম করা সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
প্রশ্ন ৪: কার্পাল টানেল সিনড্রোমে ওষুধ খাওয়া কি নিরাপদ?
উত্তর: সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। ডাক্তার প্রয়োজন মনে করলে নিরাপদ ওষুধ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন ৫: গর্ভাবস্থায় কার্পাল টানেল সিনড্রোম প্রতিরোধে কী করা উচিত?
উত্তর: পর্যাপ্ত বিশ্রাম, হাতের অতিরিক্ত কাজ এড়িয়ে চলা, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা উচিত।