জরায়ু টিউমার ও গর্ভধারণ: ভূমিকা-
একজন নারীর জীবনে মাতৃত্ব একটি স্বপ্নের মতো। তবে অনেক সময় কিছু শারীরিক সমস্যা এই স্বপ্নকে জটিল করে তোলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জরায়ু টিউমার বা ফাইব্রয়েড। এটি হলো জরায়ুর ভেতর বা চারপাশে তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিন্তু অ-ক্যান্সারজাত বৃদ্ধি। অনেক নারীর ক্ষেত্রেই এটি সন্তানধারণের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই জরায়ু টিউমার ও গর্ভধারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা অত্যন্ত জরুরি।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানব— জরায়ু টিউমার কী, এর প্রকারভেদ, কারণ, লক্ষণ, গর্ভধারণে এর প্রভাব, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়।
জরায়ু টিউমার কী?-
জরায়ু টিউমার হলো জরায়ুর ভেতরে বা বাইরের দিকে বেড়ে ওঠা অস্বাভাবিক টিস্যু। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ফাইব্রয়েড নামে পরিচিত। যদিও এটি ক্যান্সারজনিত নয়, তবে আকারে বড় হলে প্রজনন স্বাস্থ্য ও গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
জরায়ু টিউমারের প্রকারভেদ-
জরায়ু ফাইব্রয়েড, লক্ষণ, কারণ …
জরায়ু টিউমার প্রধানত দুই ধরনের হয়: ফাইব্রয়েড (বা মায়োমা), যা একটি নিরীহ বা নন-ক্যান্সারাস টিউমার এবং জরায়ুর পেশী থেকে উৎপন্ন হয়, এবং জরায়ু ক্যান্সার, যার মধ্যে প্রধান দুটি হলো এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার (জরায়ুর ভেতরের স্তরে হয়) ও জরায়ু সারকোমা (জরায়ুর পেশী বা অন্যান্য টিস্যুতে হয়)।
১. জরায়ু ফাইব্রয়েড (Uterine Fibroids):
সাধারণত নিরীহ: এটি একটি অ-ক্যান্সারযুক্ত বৃদ্ধি, যা জরায়ুর পেশী এবং সংযোগকারী টিস্যু দ্বারা গঠিত।
কারণ: জরায়ুর পেশিকোষের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে এটি তৈরি হয়। হরমোন, বিশেষ করে ইস্ট্রোজেনের মাত্রার পরিবর্তন এর আকার বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
প্রকারভেদ (অবস্থান অনুযায়ী): ফাইব্রয়েডগুলি জরায়ুর কোথায় তৈরি হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে তিন ধরনের হতে পারে:
সাবমিউকাস (Submucosal): জরায়ুর ভেতরের আস্তরণ বা এন্ডোমেট্রিয়াম-এর সাথে যুক্ত থাকে।
ইন্ট্রামিউরাল (Intramural): জরায়ুর পেশীর মধ্যে তৈরি হয়।
সাবসেরোসাল (Subserosal): জরায়ুর বাইরের দিকে থাকে।
২. জরায়ু ক্যান্সার (Uterine Cancer):
এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার (Endometrial Cancer):
সবচেয়ে সাধারণ: এটি জরায়ুর ভেতরের আস্তরণ বা এন্ডোমেট্রিয়াম থেকে শুরু হয় এবং জরায়ু ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ ধরণ।
জরায়ু সারকোমা (Uterine Sarcoma):
বিরল: এটি একটি বিরল ধরনের ক্যান্সার, যা জরায়ুর পেশী বা অন্যান্য টিস্যুতে বিকশিত হয়।
জরায়ু টিউমারের কারণ-
জরায়ু টিউমার কেন হয় তার নির্দিষ্ট কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ হলো:
- হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা (বিশেষত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন)
- জেনেটিক কারণ – পরিবারে কারো এই সমস্যা থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
- স্থূলতা ও জীবনযাপন সমস্যা
- বয়স – ৩০-৪০ বছরের নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
- অতিরিক্ত রেড মিট ও কম শাকসবজি খাওয়া
জরায়ু টিউমারের লক্ষণ-
সব নারীর ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা যায় না। তবে সাধারণত যেসব লক্ষণ দেখা দেয়:
- মাসিক চলাকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
- দীর্ঘ সময় ধরে মাসিক হওয়া
- তলপেটে চাপ বা ভারীভাব অনুভব
- ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ
- কোমর ব্যথা বা পেলভিক পেইন
- গর্ভধারণে সমস্যা
জরায়ু টিউমার ও গর্ভধারণ: সম্পর্ক-
এখন আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে— জরায়ু টিউমার ও গর্ভধারণ।
১. টিউমার গর্ভধারণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে
যদি ফাইব্রয়েড জরায়ুর আস্তরণে থাকে, তবে এটি ভ্রূণের বসবাসের জায়গা সংকুচিত করে এবং ভ্রূণকে সঠিকভাবে প্রতিস্থাপিত হতে বাধা দেয়।
২. গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে
সাবমিউকোজাল ফাইব্রয়েড গর্ভপাতের অন্যতম কারণ হতে পারে।
৩. ভ্রূণের অস্বাভাবিক অবস্থান
বড় ফাইব্রয়েড জরায়ুর ভেতরে শিশুর অবস্থান পরিবর্তন করে দিতে পারে, ফলে সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন হয়।
৪. অকাল প্রসবের ঝুঁকি
ফাইব্রয়েডের কারণে জরায়ুর সংকোচন বাড়তে পারে, যা প্রি-ম্যাচিউর লেবার ঘটাতে পারে।
৫. প্রসব-পরবর্তী জটিলতা
প্রসবের সময় রক্তক্ষরণ বেশি হতে পারে।
জরায়ু টিউমারের কারণে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কতটা কমে যায়?-
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারীর সাবমিউকোজাল ফাইব্রয়েড থাকে তাদের গর্ভধারণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। অন্যদিকে, সাবসেরোসাল ফাইব্রয়েড সাধারণত গর্ভধারণে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। তবে সব ক্ষেত্রেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করানো জরুরি।
গর্ভাবস্থায় টিউমার ধরা পড়লে করণীয়-
- নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড করানো
- গর্ভাবস্থার ঝুঁকি অনুযায়ী চিকিৎসকের নির্দেশ মানা
- হালকা ব্যথা হলে ওষুধ গ্রহণ (ডাক্তারের পরামর্শে)
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া
জরায়ু টিউমারের চিকিৎসা-
গর্ভধারণের আগে বা পরে চিকিৎসা ভিন্ন হতে পারে।
- ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা – হরমোনাল ওষুধ ব্যবহার করে ফাইব্রয়েড ছোট করা যায়।
- মায়োমেকটমি সার্জারি – টিউমার কেটে ফেলে জরায়ু অক্ষত রাখা হয়, ফলে ভবিষ্যতে গর্ভধারণ সম্ভব হয়।
- হিস্টেরেকটমি – জরায়ু সম্পূর্ণ অপসারণ করা হয়। এটি শুধুমাত্র সন্তানধারণ শেষ হলে করা হয়।
- আধুনিক লেজার ও মাইক্রো-সার্জারি – ঝুঁকি কম এবং দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়।
গর্ভধারণের আগে জরায়ু টিউমার প্রতিরোধ ও যত্ন-
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
- সুষম খাদ্য গ্রহণ (শাকসবজি ও ফল বেশি খাওয়া)
- স্থূলতা এড়ানো
- হরমোনাল ভারসাম্য ঠিক রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
- যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া
উপসংহার-
জরায়ু টিউমার ও গর্ভধারণ একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রনযোগ্য বিষয়। সব টিউমার গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি করে না, তবে অনেক ক্ষেত্রে এটি গর্ভপাত, অকাল প্রসব ও অন্যান্য ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
মনে রাখতে হবে, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে টিউমার থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী নিরাপদে গর্ভধারণ ও সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হচ্ছেন।
প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: জরায়ু টিউমার থাকলে কি গর্ভধারণ সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব। তবে টিউমারের আকার ও অবস্থান গর্ভধারণে প্রভাব ফেলে। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
প্রশ্ন ২: জরায়ু টিউমার কি সব সময় অপারেশন করতে হয়?
উত্তর: না। ছোট টিউমার ও উপসর্গহীন ফাইব্রয়েড সব সময় অপারেশন করতে হয় না। ওষুধেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় জরায়ু টিউমার হলে কি ঝুঁকি বাড়ে?
উত্তর: হ্যাঁ, এতে অকাল প্রসব, গর্ভপাত, ভ্রূণের অবস্থান সমস্যা ইত্যাদি ঝুঁকি বাড়ে।
প্রশ্ন ৪: ফাইব্রয়েড কি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে?
উত্তর: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই না। এটি একটি অ-ক্যান্সারজাত বৃদ্ধি।
প্রশ্ন ৫: গর্ভধারণের আগে কি টিউমার অপারেশন করানো উচিত?
উত্তর: টিউমারের ধরন ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে। ডাক্তার যদি মনে করেন টিউমার সন্তানধারণে বাধা সৃষ্টি করবে, তবে অপারেশন করা প্রয়োজন।