শিশুর দুঃস্বপ্ন

শিশুর দুঃস্বপ্ন – কারণ, লক্ষণ, প্রভাব ও প্রতিকার

শিশুর দুঃস্বপ্ন: ভূমিকা-

শিশুদের মানসিক বিকাশে ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক সময় ঘুমের মধ্যে শিশু হঠাৎ ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে বা আতঙ্কিত হয়। একে আমরা সাধারণত শিশুর দুঃস্বপ্ন বলে থাকি। এটি অস্বাভাবিক নয়, তবে ঘন ঘন হলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।

অনেক বাবা-মা বুঝতে পারেন না শিশুর এই দুঃস্বপ্নের আসল কারণ কী, আবার অনেকে ভয় পান এটি কোনো বড় মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ কিনা। তাই শিশুর দুঃস্বপ্ন সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি।

শিশুর দুঃস্বপ্ন কী?-

দুঃস্বপ্ন হলো ঘুমের মধ্যে ভয়ংকর, অস্বস্তিকর বা আতঙ্কজনক স্বপ্ন দেখা। শিশু যখন গভীর ঘুমে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কও বিভিন্ন তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে। এই সময়ে কিছু কারণে মস্তিষ্ক ভীতিকর ছবি বা অনুভূতি তৈরি করলে শিশুর দুঃস্বপ্ন হয়।

শিশুর দুঃস্বপ্নের সাধারণ কারণ-

১. মানসিক চাপ ও ভয়

শিশু যদি স্কুলে, বাড়িতে বা বন্ধুদের মধ্যে চাপ অনুভব করে, তবে তা দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।

২. ভয়ংকর গল্প বা টিভি অনুষ্ঠান

ঘুমের আগে ভৌতিক গল্প শোনা বা ভয়ংকর কার্টুন/সিনেমা দেখা শিশুর দুঃস্বপ্নের অন্যতম কারণ।

৩. জ্বর বা অসুস্থতা

শারীরিক অসুস্থতা বা জ্বর থাকলে শিশুর ঘুম ভেঙে দুঃস্বপ্ন দেখা দিতে পারে।

৪. অনিয়মিত ঘুম

ঘুমের অভ্যাস যদি সঠিক না হয়, যেমন দেরি করে ঘুমানো বা পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, তবে দুঃস্বপ্ন হতে পারে।

৫. পারিবারিক পরিবেশ

বাড়িতে কলহ, ঝগড়া বা অশান্তি থাকলে শিশু মানসিক চাপে ভোগে এবং এর প্রতিফলন দুঃস্বপ্নে দেখা যায়।

শিশুর দুঃস্বপ্নের লক্ষণ-

  • ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার বা কান্না
  • ভয়ে ঘুম ভেঙে যাওয়া
  • শরীর কাঁপা বা ঘাম বের হওয়া
  • পরের দিন সকালে ক্লান্তি বা বিরক্তি
  • একই ধরনের স্বপ্ন বারবার দেখা

শিশুর দুঃস্বপ্ন ও মানসিক প্রভাব-

শিশুর দুঃস্বপ্ন শুধু সাময়িক ভয়ের কারণ নয়, এটি দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন:

  • ঘুমের মান খারাপ হওয়া
  • মনোযোগের অভাব
  • পড়াশোনায় সমস্যা
  • অতিরিক্ত ভীতু বা লাজুক হয়ে পড়া
  • আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া

শিশুর দুঃস্বপ্ন প্রতিকার-

১. নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন

শিশুর ঘরটি আরামদায়ক ও নিরাপদ রাখুন। ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস নিশ্চিত করুন।

২. ইতিবাচক গল্প বলুন

ঘুমের আগে শিশুকে ভীতিকর নয়, বরং মজার, ইতিবাচক ও ইসলামিক গল্প শোনান।

৩. ঘুমের রুটিন তৈরি করুন

নিয়মিত ঘুমের সময় বজায় রাখুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

৪. মানসিক সমর্থন দিন

শিশু দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেলে তাকে আশ্বাস দিন যে এটি বাস্তব নয়। তাকে জড়িয়ে ধরুন, নিরাপদ বোধ করান।

৫. স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন

ঘুমের আগে টিভি, মোবাইল বা গেম খেলা সীমিত করুন।

৬. শারীরিক কার্যকলাপ বাড়ান

দিনে খেলা বা ব্যায়ামের মাধ্যমে শিশুর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমানো যায়।

শিশুর দুঃস্বপ্ন হলে ইসলামের নির্দেশনা-

  • আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা: শিশুকে দুঃস্বপ্ন থেকে রক্ষার জন্য আয়াতুল কুরসি, সূরা ফালাক, সূরা নাস এবং সূরা ইখলাস পড়ে তার ওপর ফুঁ দেওয়া উত্তম।

  • ঘুমানোর আগে দোয়া: রাসুল ﷺ শিখিয়েছেন ঘুমানোর আগে দোয়া পড়তে— “বিসমিকা আল্লাহুম্মা আমুতু ওয়া আহইয়া”। শিশুদেরও ছোট থেকে এসব অভ্যাস করানো ভালো।

  • অযু করে ঘুমানো: সম্ভব হলে শিশুকে অযু করিয়ে ঘুমানোর শিক্ষা দেওয়া। এতে শয়তান দূরে থাকে।

  • শিশুর মাথায় হাত রেখে দোয়া করা: যেমন— “আউযু বি কালিমাতিল্লাহিত-তাম্মাতি মিন শার্রি মা খালাক” (আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালেমার মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই)।

  • স্বপ্ন কাউকে না বলা: খারাপ স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন কারো কাছে বলার প্রয়োজন নেই, বরং আল্লাহর কাছে সুরক্ষা চাওয়া উচিত।

শিশুর দুঃস্বপ্ন প্রতিরোধের উপায়-

  • সুষম খাবার খাওয়ান
  • শোবার ঘর পরিষ্কার রাখুন
  • ঘুমানোর আগে দুধ বা হালকা পানীয় দিন
  • ইসলামিক গল্প, গজল বা সূরা তেলওয়াত করে শুনান।
  • পরিবারে শান্ত পরিবেশ বজায় রাখুন

কখন ডাক্তার দেখাবেন?-

যদি শিশুর দুঃস্বপ্ন খুব ঘন ঘন হয় এবং তার দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে, তবে অবশ্যই ডাক্তার বা শিশু মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে হবে। বিশেষ করে নিচের ক্ষেত্রে—

  • সপ্তাহে ৩-৪ বার দুঃস্বপ্ন দেখা
  • ঘুমাতে ভয় পাওয়া
  • দিনে অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগ দেখা
  • খাওয়া-দাওয়া বা পড়াশোনায় সমস্যা হওয়া

শিশুর দুঃস্বপ্ন ও অভিভাবকের ভূমিকা-

শিশু দুঃস্বপ্নে ভুগলে অভিভাবকের ধৈর্যশীল হওয়া জরুরি। শিশুকে বকাঝকা বা ভয় না দেখিয়ে ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে পাশে দাঁড়াতে হবে। অভিভাবক যদি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন, তবে শিশুর দুঃস্বপ্ন দ্রুত কমে যায়।

উপসংহার-

শিশুর দুঃস্বপ্ন একটি সাধারণ বিষয় হলেও এটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ও ঘুমের মান প্রভাবিত করতে পারে। অভিভাবকরা যদি সচেতন হন, তবে এটি অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভালোবাসা, মানসিক সমর্থন, ইতিবাচক পরিবেশ ও নিয়মিত জীবনযাপন শিশুর দুঃস্বপ্ন কমিয়ে আনতে পারে।

শিশুর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে দুঃস্বপ্নকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

 প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: শিশুর দুঃস্বপ্ন কি স্বাভাবিক?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি অনেক শিশুর মধ্যেই দেখা যায় এবং সাধারণত বেড়ে ওঠার অংশ।

প্রশ্ন ২: শিশুর দুঃস্বপ্ন কি মানসিক রোগের লক্ষণ?
উত্তর: না, তবে খুব ঘন ঘন হলে এটি মানসিক চাপের ইঙ্গিত হতে পারে।

প্রশ্ন ৩: দুঃস্বপ্ন হলে শিশুকে কী করা উচিত?
উত্তর: তাকে আশ্বস্ত করতে হবে, পাশে থাকতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে এটি শুধু স্বপ্ন।

প্রশ্ন ৪: শিশুর দুঃস্বপ্ন কমানোর উপায় কী?
উত্তর: নিয়মিত ঘুমের রুটিন, ইতিবাচক পরিবেশ, গল্প বলা এবং স্ক্রিন টাইম কমানো।

প্রশ্ন ৫: দুঃস্বপ্ন হলে কি ওষুধ প্রয়োজন?
উত্তর: সাধারণত প্রয়োজন হয় না। তবে গুরুতর হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top