গর্ভাবস্থায় পা চাবানো বা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো বা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো কী?-

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো বা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম (Restless Leg Syndrome – RLS) হলো এক ধরনের স্নায়বিক সমস্যা, যেখানে মায়ের পায়ে অস্বস্তি অনুভূত হয় এবং পা নাড়াচাড়া করার প্রবল ইচ্ছা তৈরি হয়। সাধারণত এই সমস্যা রাতে বা বিশ্রামের সময় বেশি হয়, ফলে ঘুমের সমস্যা তৈরি হয়।

বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে যে, গর্ভবতী নারীদের প্রায় ২০-২৫% কোনো না কোনোভাবে এই সমস্যায় ভোগেন। যদিও এটি শিশুর সরাসরি ক্ষতি করে না, তবে মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।

গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর কারণ-

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো—

  • আয়রনের ঘাটতি: গর্ভাবস্থায় শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে অনেক সময় আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয় যা RLS-এর মূল কারণ।
  • ফোলেট বা ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতি।
  • ডোপামিন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: স্নায়ুর সঠিক কাজকর্মে ডোপামিন জরুরি। এর ঘাটতি হলে পায়ে অস্বস্তি হয়।
  • গর্ভাবস্থার হরমোন পরিবর্তন: বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের পরিবর্তন পায়ের স্নায়ুকে প্রভাবিত করে।
  • স্ট্রেস ও মানসিক চাপ।
  • পারিবারিক ইতিহাস: কারও পরিবারে এই সমস্যা থাকলে গর্ভাবস্থায় এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর লক্ষণ-

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো সমস্যার কিছু স্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে—

  • পায়ে অস্বস্তি, ঝিনঝিন বা সুচ ফোটার মতো অনুভূতি
  • পা নাড়াচাড়া করার প্রবল ইচ্ছা
  • রাতে বা ঘুমানোর সময় সমস্যা বেশি হওয়া
  • পা নাড়ালে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া
  • ঘুমের ব্যাঘাত ও ক্লান্তি

কখন বেশি হয় এই সমস্যা?-

  • রাতে শোয়ার সময়
  • দীর্ঘ সময় বসে থাকা অবস্থায় (যেমন ভ্রমণের সময়)
  • গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে

গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর ঝুঁকি-

যদিও সরাসরি শিশুর ঝুঁকি নেই, তবে গর্ভাবস্থায় পা চাবানো মায়ের জন্য বিভিন্ন সমস্যার কারণ হতে পারে—

  • ঘুমের সমস্যা
  • ক্লান্তি ও অবসাদ
  • মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
  • মানসিক চাপ বৃদ্ধি
  • প্রসব-পরবর্তী হতাশার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো নির্ণয়-

ডাক্তাররা সাধারণত নিচের পদ্ধতিতে গর্ভাবস্থায় পা চাবানো বা RLS নির্ণয় করেন—

  • রোগীর ইতিহাস ও উপসর্গ পর্যবেক্ষণ
  • আয়রন লেভেল ও রক্তপরীক্ষা
  • অন্যান্য সম্ভাব্য রোগ (ডায়াবেটিস, নার্ভ ডিসঅর্ডার) বাদ দেওয়া

গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর প্রতিকার-

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো কমাতে কিছু সহজ প্রতিকার অনুসরণ করা যেতে পারে—

  • পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করুন: 
    এই খনিজগুলির অভাবে পা চাবানো বা খিঁচুনি হতে পারে। কলা, অ্যাপ্রিকট, কমলা, মিষ্টি আলু, বিট, এবং সবুজ শাকসবজি এই ঘাটতি পূরণে সহায়ক।
  • সুষম খাবার খাওয়া: সবুজ শাকসবজি, ডাল, মাংস, ডিম, দুধ খাওয়া জরুরি।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: হালকা হাঁটা, স্ট্রেচিং ও যোগব্যায়াম উপকারী।
  • ম্যাসাজ ও গরম পানির সেঁক: পায়ের অস্বস্তি কমাতে সহায়তা করে।
  • ক্যাফেইন ও চিনি কম খাওয়া।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: নিয়মিত ঘুমের রুটিন মেনে চলা জরুরি।
  • প্রচুর পানি পান করুন: শরীরকে আর্দ্র রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা জরুরি, যা পেশিতে টান লাগা প্রতিরোধে সাহায্য করে। 
  • আয়রন ও ফোলেট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ: ডাক্তারের পরামর্শে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া।

গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর চিকিৎসা-

গর্ভাবস্থায় ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয়। সাধারণত—

  • আয়রন সাপ্লিমেন্ট
  • ভিটামিন বি-১২ ও ফোলেট
  • কিছু ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্ট

ডাক্তাররা প্রয়োজন ছাড়া ঘুমের ওষুধ দেন না, কারণ তা শিশুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই কোনো ধরনের ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভাবস্থায় পা চাবানো কমানোর উপায়-

  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা
  • হালকা যোগব্যায়াম
  • শোয়ার আগে হালকা গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখা
  • শরীরে পানি শূন্যতা এড়ানো
  • মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন বা প্রার্থনা করা

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো প্রতিরোধে করণীয়-

  • গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই নিয়মিত চেকআপ
  • আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
  • ধূমপান, অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
  • মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো ও ঘুমের সমস্যা-

এই সমস্যা ঘুমকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। অনেক নারী রাতে ঘুমাতে পারেন না, ফলে দিনের বেলায় ক্লান্তি ও মাথাব্যথা হয়। তাই ঘুমানোর আগে শরীরকে রিল্যাক্স করা এবং ঘুমের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশে গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর প্রেক্ষাপট-

বাংলাদেশে অনেক নারী গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর সমস্যা অনুভব করলেও সচেতনতার অভাবে একে সাধারণ ক্লান্তি বা রক্তশূন্যতা ভেবে অবহেলা করেন। কিন্তু সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

উপসংহার-

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো বা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম একটি সাধারণ সমস্যা হলেও মায়ের জীবনের মান নষ্ট করে দেয়। সঠিক পুষ্টি, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এ সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো সম্পর্কিত প্রশ্ন-

 গর্ভাবস্থায় পা চাবানো কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, এটি অনেক নারীর ক্ষেত্রেই ঘটে। তবে নিয়মিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

 গর্ভাবস্থায় পা চাবানোর প্রধান কারণ কী?
আয়রন ঘাটতি, হরমোন পরিবর্তন ও স্নায়বিক সমস্যাই মূল কারণ।

 পা চাবানোর সমস্যা কি শিশুর ক্ষতি করে?
সরাসরি শিশুর ক্ষতি করে না, তবে মায়ের ঘুম ও স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।

 গর্ভাবস্থায় পা চাবানো কমানোর ঘরোয়া উপায় কী?
হাঁটা, গরম পানিতে পা ডুবানো, ম্যাসাজ ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা।

গর্ভাবস্থায় পা চাবানো কি প্রসবের পর চলে যায়?
হ্যাঁ, সাধারণত প্রসবের পর এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যায় বা সম্পূর্ণ সেরে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top