ইসলামে শিশু পরিচর্যা: একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি-
ইসলামে শিশু পরিচর্যা একটি পবিত্র দায়িত্ব ও আমানত। আল্লাহ তায়ালা সন্তানকে মানুষের জন্য রহমত হিসেবে দান করেছেন এবং বাবা-মার উপর এর সঠিক লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। শিশুর জন্মের পর থেকে শিক্ষা, আচার-আচরণ, ইবাদত, নৈতিকতা, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।
(ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয়: পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক নির্দেশনা)
শিশুর জন্মের পর ইসলামের প্রথম পদক্ষেপ-
শিশু জন্মের পর বাবা-মাকে যেসব পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হলো:
- আজান ও ইকামত: শিশুর ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দেওয়া সুন্নত। এটি তার জীবনের প্রথমেই আল্লাহর নাম শুনানোর শিক্ষা।
- আকীকা: ছেলে সন্তানের জন্য দুটি এবং মেয়ে সন্তানের জন্য একটি পশু কোরবানি করার মাধ্যমে আকীকা করা হয়।
- নামকরণ: সুন্দর অর্থবোধক ও ইসলামি নাম রাখা শিশু পরিচর্যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবী করীম ﷺ বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের সুন্দর নাম দাও।”
- দুধ পান: মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশু লালন-পালনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে, যে চায় তার সন্তানকে তার মায়ের দুধ পান পূর্ণ করতে। আর সন্তানের পিতাগণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ওদের (সন্তানদের মায়েদের) জীবনোপকরণ (পুষ্টিকর খাবার) ও আরামদায়ক পোশাক (এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের) ব্যবস্থা করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৩৩)।
ইসলামে শিশু লালন-পালনের মূলনীতি-
শিশু পরিচর্যা কেবল শারীরিক যত্ন নয়, বরং মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের সামগ্রিক দিককে অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলামে শিশু লালন-পালনের মূলনীতি হলো:
- আকীদা ও ঈমান শিক্ষা – শিশুকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাওহীদ ও নবীর সুন্নাহর প্রতি আনুগত্য শেখানো।
- সুন্দর চরিত্র গঠন – ছোটবেলা থেকেই সত্যবাদিতা, ধৈর্য, দয়া, নম্রতা, ও দায়িত্ববোধ শেখানো।
- ইবাদতের শিক্ষা – নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াতসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদতের শিক্ষা দেওয়া।
- শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন – দুনিয়াবি ও দীনি উভয় শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করা। নবী ﷺ বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ।”
- আদব ও আচার – অভিভাবকদের প্রতি সম্মান, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার ও সমাজে ভদ্র আচরণ শেখানো।
শিশু পরিচর্যায় বাবা-মায়ের দায়িত্ব-
ইসলামে শিশু পরিচর্যার বড় অংশ বাবা-মায়ের দায়িত্বের উপর নির্ভরশীল।
- স্নেহ ও ভালোবাসা দেওয়া: নবী ﷺ শিশুদের প্রতি অত্যন্ত মমতাশীল ছিলেন। তিনি শিশুদেরকে কাঁধে উঠাতেন, চুম্বন করতেন এবং দোয়া দিতেন।
- শিক্ষক হিসেবে ভূমিকা: বাবা-মা সন্তানের প্রথম শিক্ষক। তাই তারা যা শিখাবে, সন্তান সেটাই অনুসরণ করবে।
- হালাল রুজি প্রদান: শিশুকে হালাল খাদ্য খাওয়ানো ঈমানি দায়িত্ব। হারাম খাদ্য তার চরিত্র ও ঈমানকে দুর্বল করে।
- শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা: শিশুকে সহিংসতা, অশ্লীলতা ও খারাপ পরিবেশ থেকে রক্ষা করা।
- ন্যায়পরায়ণতা: সন্তানের প্রতি সমান আচরণ করা। ইসলাম কঠোরভাবে পক্ষপাতিত্ব নিরুৎসাহিত করে।
ইসলামে শিশু শিক্ষা-
কুরআন ও হাদীসে শিশুর শিক্ষার উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
- কুরআন শিক্ষা: ছোটবেলা থেকেই কুরআন শেখানো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
- ইবাদতের অভ্যাস: ৭ বছর বয়সে নামাজ শেখানো এবং ১০ বছর বয়সে নামাজের ব্যাপারে দৃঢ় করা।
- নৈতিক শিক্ষা: সত্যবাদিতা, ধৈর্য, শিষ্টাচার, আমানতদারিত্ব শেখানো।
- দুনিয়াবি শিক্ষা: বিজ্ঞান, ইতিহাস, চিকিৎসা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে।
ইসলামে শিশু পরিচর্যার উপকারিতা-
ইসলামি পদ্ধতিতে শিশু পরিচর্যার ফলে শিশুর জীবনে যে উপকারিতা দেখা যায়:
- আল্লাহভীরু চরিত্র গঠন
- সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ
- ভালো সামাজিক আচরণ
- দীনি ও দুনিয়াবি উভয় ক্ষেত্রে সাফল্য
- পরিবার ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা
ইসলামে শিশু পরিচর্যার বিরুদ্ধে অবহেলার পরিণতি-
শিশু পরিচর্যায় অবহেলা করলে শিশুর জীবনে ও সমাজে ভয়াবহ পরিণতি দেখা দেয়। যেমন:
- ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি
- অসামাজিক আচরণ বৃদ্ধি
- মাদক ও অপরাধে জড়িয়ে পড়া
- বাবা-মায়ের প্রতি অবাধ্যতা
- নৈতিক অবক্ষয়
শিশু পরিচর্যায় আধুনিক চ্যালেঞ্জ ও ইসলামি সমাধান-
আজকের যুগে শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন: প্রযুক্তি আসক্তি, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক ভাঙন ইত্যাদি। ইসলামি সমাধান হলো:
- শিশুদেরকে প্রযুক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার শেখানো
- পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা
- দীনী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা
- সমাজে ভালো বন্ধু নির্বাচন করা
- মসজিদ ও ইসলামি কার্যক্রমে শিশুদের সম্পৃক্ত করা
উপসংহার-
ইসলামে শিশু পরিচর্যা শুধুমাত্র শারীরিক যত্ন নয় বরং আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানসিক বিকাশের সামগ্রিক দিককে অন্তর্ভুক্ত করে। কুরআন ও হাদীসে শিশু লালন-পালনের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাই প্রতিটি মুসলিম পরিবারের দায়িত্ব হলো সন্তানকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা, নৈতিক চরিত্র গঠন করা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করা।
ইসলামে শিশু পরিচর্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: ইসলামে শিশু জন্মের পর প্রথম করণীয় কী?
উত্তর: শিশুর ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া, আকীকা করা, সুন্দর নাম রাখা এবং মাথা মুণ্ডন করা সুন্নত।
প্রশ্ন ২: ইসলামে শিশুকে কতদিন দুধ পান করানো উচিত?
উত্তর: কুরআন অনুযায়ী মা দুই বছর পর্যন্ত সন্তানকে দুধ খাওয়াবে।
প্রশ্ন ৩: ইসলামে শিশুর শিক্ষা কিভাবে শুরু হবে?
উত্তর: প্রথমে কুরআন শিক্ষা, ঈমান ও আকীদার শিক্ষা, এরপর নামাজ, রোজা এবং নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হবে।
প্রশ্ন ৪: বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি দায়িত্ব কী?
উত্তর: সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, ন্যায়পরায়ণতা, হালাল রুজি, শিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
প্রশ্ন ৫: শিশু পরিচর্যায় অবহেলা করলে কী হয়?
উত্তর: শিশু নৈতিকতা হারায়, ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয় এবং সমাজে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে।