জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট: ব্যবহার, কার্যকারিতা, সুবিধা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট: ভূমিকা-

বর্তমান সময়ে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নানা ধরণের গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতিগুলোর একটি হলো জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট। এটি একটি ছোট, নমনীয় প্লাস্টিকের স্টিক যা নারীর উপরের বাহুর ত্বকের নিচে প্রতিস্থাপন করা হয়। ইমপ্ল্যান্ট ধীরে ধীরে হরমোন নিঃসরণ করে, যা গর্ভধারণ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানব জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট সম্পর্কে—এর ব্যবহার পদ্ধতি, কার্যকারিতা, সুবিধা, অসুবিধা ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কী?-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট হলো একটি হরমোনাল গর্ভনিরোধক পদ্ধতি। সাধারণত এটি প্রায় ৪ সেন্টিমিটার লম্বা ও ম্যাচস্টিকের মতো পাতলা একটি প্লাস্টিকের স্টিক, যা নারীর বাহুর ত্বকের নিচে প্রতিস্থাপন করা হয়।

ইমপ্ল্যান্ট থেকে প্রোজেস্টিন নামক হরমোন শরীরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। এই হরমোন মূলত—

  • ডিম্বাণু তৈরি ও পরিপক্ব হওয়া বন্ধ করে,
  • জরায়ুর গ্রীবার শ্লেষ্মা ঘন করে, যাতে শুক্রাণু প্রবেশ করতে না পারে,
  • জরায়ুর আস্তরণ পাতলা করে দেয়, যাতে নিষিক্ত ডিম্বাণু স্থাপন হতে না পারে।

ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কতদিন কার্যকর থাকে?-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট একবার প্রতিস্থাপন করলে এটি ৩-৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। সময় শেষে ইমপ্ল্যান্ট পরিবর্তন করতে হয়। অনেক দেশে সবচেয়ে প্রচলিত ইমপ্ল্যান্ট হলো নেক্সপ্লানন (Nexplanon), যা ৩ বছর কার্যকর থাকে।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কীভাবে বসানো হয়?-

ইমপ্ল্যান্ট বসানোর প্রক্রিয়া খুব সহজ এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন করা যায়।

  • সাধারণত বাহুর ভেতরের অংশে ছোট একটি ইনজেকশনের মতো কাটা দিয়ে ইমপ্ল্যান্ট প্রবেশ করানো হয়।
  • স্থানীয় অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে জায়গাটি অবশ করে দেওয়া হয়, তাই ব্যথা তেমন লাগে না।
  • প্রতিস্থাপন শেষে জায়গায় ছোট একটি ব্যান্ডেজ দেওয়া হয়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের কার্যকারিতা-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গর্ভনিরোধক পদ্ধতিগুলোর একটি।

  • সঠিকভাবে প্রতিস্থাপন করলে এর কার্যকারিতা ৯৯% এর বেশি
  • অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে মাত্র ১ জন অনিচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী হতে পারেন।
  • প্রতিদিন বা প্রতি মাসে কোনো ঝামেলা নেই, একবার প্রতিস্থাপন করলে বহু বছর নিশ্চিন্ত থাকা যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের সুবিধা-

  • অত্যন্ত কার্যকর – গর্ভধারণ প্রতিরোধে প্রায় শতভাগ কার্যকর।
  • দীর্ঘস্থায়ী – একবার বসালে ৩-৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।
  • ঝামেলাহীন – প্রতিদিন বড়ি খাওয়া বা প্রতি ৩ মাসে ইনজেকশন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
  • গোপনীয়তা – বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে কেউ গর্ভনিরোধক ব্যবহার করছেন।
  • স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য নিরাপদ – সন্তান জন্মের ৬ সপ্তাহ পর থেকে ব্যবহার করা যায়।
  • প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে – ইমপ্ল্যান্ট অপসারণের পর দ্রুতই গর্ভধারণ সম্ভব হয়।
  • জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক – গবেষণায় দেখা গেছে হরমোনাল ইমপ্ল্যান্ট কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের অসুবিধা-

যদিও এর সুবিধা অনেক, তবে কিছু অসুবিধাও রয়েছে—

  • মাসিকের পরিবর্তন – কারো মাসিক অনিয়মিত হতে পারে, আবার কারো মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
  • প্রতিস্থাপনে অস্বস্তি – বসানোর পর কয়েকদিন বাহুতে ব্যথা বা ফোলা থাকতে পারে।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – মাথাব্যথা, ওজন বৃদ্ধি, ব্রণ, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি হতে পারে।
  • অপারেটিভ পদ্ধতি – বসানো ও তোলার জন্য চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হয়।
  • মূল্য তুলনামূলক বেশি – অন্য জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতির চেয়ে খরচ কিছুটা বেশি।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া-

ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহারের পর কিছু নারী নিম্নলিখিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারেন—

  • মাসিক অনিয়মিত হওয়া।
  • মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা।
  • শরীরে ওজন বৃদ্ধি।
  • বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি।
  • মানসিক খিটখিটে ভাব বা ডিপ্রেশন।
  • প্রতিস্থাপন স্থানে ব্যথা, ফোলা বা কালচে দাগ।

তবে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবার ক্ষেত্রে দেখা যায় না, এবং অনেক সময় কয়েক মাস পর স্বাভাবিক হয়ে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কারা ব্যবহার করতে পারবেন না?-

কিছু ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। যেমন—

  • যাদের স্তন ক্যান্সার আছে বা ছিল।
  • যাদের রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা রয়েছে।
  • যাদের লিভারের গুরুতর অসুখ আছে।
  • যেসব নারী নির্দিষ্ট হরমোনে অ্যালার্জি প্রবণ।

এই কারণে ইমপ্ল্যান্ট প্রতিস্থাপনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের খরচ-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের খরচ সাধারণত অন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির তুলনায় কিছুটা বেশি। বাংলাদেশে সরকারি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র বা ক্লিনিকে অনেক সময় এটি ফ্রি বা স্বল্প খরচে পাওয়া যায়। তবে বেসরকারি হাসপাতালে বা ক্লিনিকে প্রতিস্থাপনের খরচ সাধারণত ৩,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যা ব্র্যান্ড ও ক্লিনিক ভেদে ভিন্ন হয়।

 

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট বনাম জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন-

বিষয় জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন
স্থায়িত্ব ৩-৫ বছর ৩ মাস
কার্যকারিতা ৯৯% এর বেশি ৯৯%
ব্যবহার পদ্ধতি একবার প্রতিস্থাপন প্রতি ৩ মাসে ইনজেকশন
সুবিধা দীর্ঘস্থায়ী, দ্রুত প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে তুলনামূলক সস্তা, সহজলভ্য
অসুবিধা বসানো ও তোলার জন্য চিকিৎসকের সহায়তা লাগে মাসিকের পরিবর্তন, নিয়মিত নিতে হয়

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট অপসারণ-

যদি কোনো নারী সন্তান নিতে চান বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করতে না পারেন, তবে সহজেই ইমপ্ল্যান্ট অপসারণ করা যায়।

  • ছোট একটি কাটার মাধ্যমে স্টিক বের করে আনা হয়।
  • সাধারণত ৫-১০ মিনিট সময় লাগে।
  • অপসারণের পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নারীর প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে।

উপসংহার-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি, কার্যকর ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। যারা বহু বছর নিশ্চিন্তে সন্তান না নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন এবং প্রতিদিন বড়ি খাওয়ার ঝামেলা এড়াতে চান, তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ উপায়। যদিও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করলে এটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর।

প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কতটা কার্যকর?
উত্তর: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট ৯৯% এর বেশি কার্যকর।

প্রশ্ন ২: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কতদিন কার্যকর থাকে?
উত্তর: একবার প্রতিস্থাপন করলে এটি ৩-৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

প্রশ্ন ৩: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট বসানো কি কষ্টকর?
উত্তর: না, স্থানীয় অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হয় বলে বসানোর সময় ব্যথা লাগে না। তবে পরে কয়েকদিন অল্প ব্যথা বা ফোলা থাকতে পারে।

প্রশ্ন ৪: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কি স্তন্যদায়ী মায়েরা ব্যবহার করতে পারবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, সন্তান জন্মের ৬ সপ্তাহ পর থেকে স্তন্যদায়ী মায়েরা নিরাপদে ব্যবহার করতে পারেন।

প্রশ্ন ৫: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট অপসারণের পর কি গর্ভধারণ সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, ইমপ্ল্যান্ট অপসারণের পর দ্রুতই প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে।

প্রশ্ন ৬: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্টের প্রধান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী?
উত্তর: মাসিক অনিয়মিত হওয়া, মাথাব্যথা, ওজন বৃদ্ধি, মানসিক অস্থিরতা, প্রতিস্থাপন স্থানে ব্যথা ইত্যাদি।

প্রশ্ন ৭: জন্মনিয়ন্ত্রন ইমপ্ল্যান্ট কি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়?
উত্তর: না, বরং জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top