গর্ভাবস্থায় MRI নিরাপদ কিনা? একটি বিস্তারিত আলোচনা-
গর্ভাবস্থার সময় একজন নারীর শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটে, যা অনেক সময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অনেক সময় চিকিৎসকেরা সঠিক নির্ণয়ের জন্য ইমেজিং টেস্ট যেমন MRI করার পরামর্শ দেন। কিন্তু গর্ভবতী নারীর মনে তখনই এক বড় প্রশ্ন আসে — গর্ভাবস্থায় MRI নিরাপদ কিনা? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে MRI কীভাবে কাজ করে, এর প্রভাব কী হতে পারে এবং কোন পরিস্থিতিতে এটি করা প্রয়োজন হতে পারে।
MRI কীভাবে কাজ করে-
MRI বা Magnetic Resonance Imaging হলো এমন এক ধরনের ইমেজিং পদ্ধতি যেখানে শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত ছবি তোলা হয়। এতে কোনো এক্স-রে বা আয়নাইজিং রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না, যা সাধারণত CT স্ক্যান বা এক্স-রের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
এ কারণেই চিকিৎসকেরা মনে করেন, গর্ভাবস্থায় MRI তুলনামূলকভাবে নিরাপদ একটি পদ্ধতি, বিশেষ করে যখন এটি ভ্রূণের কোনো ক্ষতি ছাড়াই সঠিক ডায়াগনোসিসে সাহায্য করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় MRI করার প্রয়োজনীয়তা-
গর্ভাবস্থার সময় MRI সাধারণত তখনই করা হয় যখন মায়ের শরীরে এমন কোনো জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয় যা অন্য কোনো নিরাপদ পরীক্ষায় নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। যেমন:
গর্ভবতী মায়ের মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড বা জয়েন্টে সমস্যা
প্লাসেন্টা বা জরায়ুর অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে
ভ্রূণের বিকাশে কোনো জটিলতা দেখা দিলে
মায়ের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার বা পেটের অংশে টিউমার বা অস্বাভাবিকতা সন্দেহ হলে
এই ধরনের ক্ষেত্রে MRI একটি কার্যকর ও তুলনামূলক নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।
গর্ভাবস্থায় MRI নিরাপদ কিনা?-
চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস বা প্রথম ট্রাইমেস্টারে MRI করা হলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এই সময়টিতে শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে MRI ভ্রূণের ক্ষতি করে, তবুও চিকিৎসকেরা প্রথম তিন মাসে MRI করা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন যদি না তা একেবারেই জরুরি হয়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে MRI সাধারণত নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ তখন শিশুর অঙ্গগুলো বেশ গঠিত থাকে এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রভাবও খুব সামান্য হয়।
গর্ভাবস্থায় MRI-তে ব্যবহৃত কনট্রাস্ট পদার্থ-
অনেক সময় MRI স্ক্যানের সময় শরীরে গ্যাডোলিনিয়াম (Gadolinium) নামের একটি কনট্রাস্ট পদার্থ প্রয়োগ করা হয় যাতে অঙ্গের ছবি আরও পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়।
তবে গর্ভাবস্থায় এই কনট্রাস্ট পদার্থ সাধারণত ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ এটি প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
তাই গর্ভবতী মায়ের MRI প্রয়োজন হলে চিকিৎসক সাধারণত নন-কনট্রাস্ট MRI করার সিদ্ধান্ত নেন।
গর্ভাবস্থায় MRI করার আগে যা জানার প্রয়োজন-
গর্ভাবস্থায় MRI করার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা জরুরি —
চিকিৎসককে অবশ্যই জানাতে হবে আপনি গর্ভবতী কিনা বা কত সপ্তাহের গর্ভাবস্থা চলছে।
MRI করার আগে শরীর থেকে ধাতব বস্তু যেমন গয়না, ক্লিপ বা বেল্ট খুলে ফেলতে হবে।
যদি কোনো ইনপ্ল্যান্ট, পেসমেকার বা মেটালিক ডিভাইস শরীরে থাকে, তবে MRI করার আগে তা চিকিৎসককে জানাতে হবে।
কোনো ধরনের কনট্রাস্ট ব্যবহার করা হবে কিনা তা চিকিৎসকের সঙ্গে পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় MRI করার সময় শিশুর ওপর প্রভাব-
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, MRI স্ক্যানের সময় ব্যবহৃত ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও রেডিও ওয়েভ ভ্রূণের তাপমাত্রায় সামান্য পরিবর্তন ঘটাতে পারে, তবে তা সাধারণত ক্ষতিকর নয়।
MRI চলাকালীন সময় ভ্রূণ কিছুটা নড়াচড়া করতে পারে, তবে এর ফলে কোনো স্থায়ী প্রভাব পড়ে না। তাই এটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ইমেজিং পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
গর্ভাবস্থায় MRI এবং আলট্রাসাউন্ডের পার্থক্য-
নিচে গর্ভাবস্থায় MRI এবং আলট্রাসাউন্ডের পার্থক্য সুন্দরভাবে টেবিল আকারে দেওয়া হলো —
বিষয় | MRI (Magnetic Resonance Imaging) | আলট্রাসাউন্ড (Ultrasound) |
---|---|---|
প্রযুক্তি | শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে ছবি তোলে | সাউন্ড ওয়েভ বা শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে ছবি তৈরি করে |
রেডিয়েশন ব্যবহার | কোনো রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না | কোনো রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না |
ছবির গুণগত মান | ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের খুব বিস্তারিত ও স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় | সাধারণত শিশুর অবস্থান ও নড়াচড়া দেখতে যথেষ্ট স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় |
ব্যবহারের সময় | যখন আলট্রাসাউন্ডে সমস্যা স্পষ্ট বোঝা যায় না বা জটিল রোগ নির্ণয় প্রয়োজন হয় | গর্ভাবস্থার নিয়মিত চেকআপে এবং শিশুর বিকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয় |
সময় লাগে | তুলনামূলকভাবে বেশি সময় লাগে (৩০–৬০ মিনিট পর্যন্ত) | সময় কম লাগে (৫–১৫ মিনিট সাধারণত) |
খরচ | তুলনামূলকভাবে বেশি (৫,০০০–১২,০০০ টাকা পর্যন্ত) | তুলনামূলকভাবে কম (৮০০–২,০০০ টাকা পর্যন্ত) |
গর্ভাবস্থায় নিরাপত্তা | সাধারণত নিরাপদ, তবে প্রথম ট্রাইমেস্টারে সতর্কতা দরকার | সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি |
শিশুর ওপর প্রভাব | ভ্রূণের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি, তবে কনট্রাস্ট ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে | কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই |
ব্যবহারিক উদ্দেশ্য | ভ্রূণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, প্লাসেন্টা, মায়ের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ পরীক্ষা | শিশুর হৃদস্পন্দন, অবস্থান, ওজন ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ |
চিকিৎসকের পরামর্শ | শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে করা হয় | গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যবহৃত ও পরামর্শকৃত পরীক্ষা |
গর্ভাবস্থায় MRI করার সময় মানসিক প্রস্তুতি-
MRI করার সময় অনেকেই ভয় বা উদ্বেগ অনুভব করেন, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা। তবে জানা দরকার, MRI-তে কোনো ব্যথা হয় না। এটি কেবল একটি যন্ত্রের ভেতরে শুয়ে থাকার প্রক্রিয়া, যেখানে মেশিন কিছুটা শব্দ করে।
যদি ক্লস্ট্রোফোবিয়া (সংকীর্ণ জায়গার ভয়) থাকে, তাহলে চিকিৎসককে জানালে তারা সেডেটিভ ওষুধ দিতে পারেন। তবে গর্ভাবস্থায় এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারেও সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
গর্ভাবস্থায় MRI করার সময় কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন-
গর্ভাবস্থায় MRI করাতে হলে সবসময় অভিজ্ঞ রেডিওলজিস্ট ও গাইনোকোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে করা উচিত।
হাসপাতাল বা ক্লিনিকের MRI মেশিন যেন আধুনিক ও নিরাপত্তা মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
MRI করার সময় শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং আরামদায়কভাবে অবস্থান নেওয়া উচিত।
কোনো ধরনের কনট্রাস্ট পদার্থ প্রয়োগের আগে চিকিৎসকের অনুমতি নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় MRI করার খরচ-
বাংলাদেশে MRI স্ক্যানের খরচ নির্ভর করে হাসপাতাল, মেশিনের ধরন এবং পরীক্ষা কোন অংশে করা হচ্ছে তার ওপর। গড়ে খরচ ৫,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে গর্ভাবস্থায় বিশেষ সতর্কতার কারণে কিছু জায়গায় খরচ কিছুটা বেশি হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় MRI নিরাপদ কিনা? চিকিৎসকদের মতামত-
চিকিৎসকদের মতে, গর্ভাবস্থায় MRI একটি রিস্ক-ফ্রি ও নন-রেডিয়েশন ইমেজিং পদ্ধতি, যা ভ্রূণের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তবে চিকিৎসকরা এটি শুধুমাত্র তখনই করেন যখন মায়ের বা শিশুর কোনো জটিল অবস্থা তা ছাড়া নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
তারা আরও বলেন, অপ্রয়োজনে MRI না করাই উত্তম। বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে MRI এড়িয়ে চলা উচিত।
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় MRI করা নিয়ে অনেকের মনে ভয় থাকে, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি নন-রেডিয়েশন ও নিরাপদ ইমেজিং পদ্ধতি যা চিকিৎসকের পরামর্শে করা হলে মায়ের ও শিশুর কোনো ক্ষতি হয় না। তবে প্রথম ট্রাইমেস্টারে MRI করা এড়িয়ে চলা ভালো যদি তা একান্ত প্রয়োজনীয় না হয়।
সবশেষে, গর্ভবতী মায়ের উচিত কোনো পরীক্ষা করানোর আগে নিজের চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা, যাতে সিদ্ধান্তটি হয় নিরাপদ ও সচেতনতার ভিত্তিতে। গর্ভাবস্থায় MRI নিরাপদ কিনা?
গর্ভাবস্থায় MRI নিরাপদ কিনা? এ সম্পর্কে প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় MRI কি পুরোপুরি নিরাপদ?
উত্তর: সাধারণভাবে নিরাপদ, বিশেষ করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে। তবে প্রথম তিন মাসে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া না করাই ভালো।
প্রশ্ন: MRI কি শিশুর ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে?
উত্তর: এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে MRI ভ্রূণের ক্ষতি করে।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় কনট্রাস্টসহ MRI করা যায় কি?
উত্তর: গ্যাডোলিনিয়াম কনট্রাস্ট সাধারণত গর্ভাবস্থায় ব্যবহার করা হয় না, কারণ এটি শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
প্রশ্ন: MRI করার আগে কী প্রস্তুতি নিতে হয়?
উত্তর: শরীর থেকে সব ধাতব বস্তু সরিয়ে ফেলতে হবে এবং চিকিৎসককে গর্ভাবস্থার তথ্য জানাতে হবে।
প্রশ্ন: MRI না করে বিকল্প কী হতে পারে?
উত্তর: অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলট্রাসাউন্ডই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর বিকল্প।