গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা: কারণ, লক্ষণ, করণীয় ও সতর্কতা

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা: কী, কেন এবং কখন ঘটে?-

গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে মায়ের শরীরে এমন কিছু লক্ষণ দেখা দেয় যা জানিয়ে দেয়—প্রসবের সময় খুব কাছাকাছি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা। অনেক মায়েরা হঠাৎ পানি পড়লে ভয় পান, কেউ আবার বিভ্রান্ত হন এটা কি প্রসবের শুরু নাকি অন্য কিছু।

আজকের এই ব্লগে বিস্তারিতভাবে জানব গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গার কারণ, লক্ষণ, সময়, করণীয় এবং কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা কী?-

শিশু যখন মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠে, তখন সে থাকে একটি তরল পদার্থে ঘেরা থলির মধ্যে, যাকে বলা হয় অ্যামনিওটিক স্যাক। এই তরলটি হলো অ্যামনিওটিক ফ্লুইড, যা শিশুকে আঘাত থেকে রক্ষা করে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং নড়াচড়া করতে সাহায্য করে।

প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে এই থলি ফেটে যায়, এবং ভিতরের পানি বাইরে বেরিয়ে আসে। একেই বলা হয় গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা বা পানি পড়া

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গার কারণ-

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি আগে ভেঙে যেতে পারে। নিচে এর কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো—

  • প্রসবের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া:
    গর্ভকাল পূর্ণ হলে প্রসব শুরু হওয়ার আগে অ্যামনিওটিক থলি স্বাভাবিকভাবেই ফেটে যায়।
  • ইনফেকশন বা প্রদাহ:
    জরায়ু বা যোনিতে সংক্রমণ থাকলে থলি দুর্বল হয়ে আগে ফেটে যেতে পারে।
  • অতিরিক্ত চাপ বা আঘাত:
    হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ভারী কিছু তোলা বা পেটের ওপর চাপ পড়লে পানি ফেটে যেতে পারে।
  • একাধিক গর্ভ (যমজ বা ত্রৈমাসিক গর্ভ):
    একাধিক শিশুর চাপের কারণে অ্যামনিওটিক স্যাক দ্রুত ফেটে যেতে পারে।
  • ধূমপান বা অপুষ্টি:
    এসব অভ্যাসে জরায়ুর টিস্যু দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে পানি ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গার লক্ষণ-

অনেক মা প্রথমে বুঝতেই পারেন না যে তাদের পানি ভেঙেছে। তাই নিচের লক্ষণগুলো জানলে সহজে বোঝা যায়—

  • যোনি দিয়ে হঠাৎ করে তরল নির্গত হওয়া
  • পানি স্বচ্ছ, হালকা হলুদ বা সামান্য সাদা হতে পারে
  • গন্ধ সাধারণত হালকা ও মিষ্টি ধরনের হয় (প্রস্রাবের মতো নয়)
  • কিছু সময় একটানা ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে থাকে
  • প্রসব ব্যথা শুরু হতে পারে পানি ভাঙার পর

যদি পানি একবারে অনেকটা বেরিয়ে যায়, তবে কাপড় বা বিছানা ভিজে যেতে পারে।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গলে কী করবেন-

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা হলে ভয় না পেয়ে নিচের পদক্ষেপগুলো নিতে হবে—

  • শান্ত থাকুন:
    আতঙ্কিত হলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। প্রথমে শান্তভাবে পরিস্থিতি বুঝুন।
  • সময় লক্ষ্য করুন:
    পানি পড়ার সময় ও পরিমাণ মনে রাখুন। ডাক্তারের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
  • পানি বা তরলের রঙ দেখুন:
    যদি পানি সবুজ, বাদামী বা রক্ত মেশানো হয়, তাহলে এটি জরুরি অবস্থা।
  • প্রসব ব্যথা শুরু হয়েছে কিনা দেখুন:
    সাধারণত পানি ভাঙার ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রসব ব্যথা শুরু হয়।
  • হাসপাতালে যান:
    পানি পড়া শুরু হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছানো জরুরি, কারণ পানি ভাঙার পর শিশুর সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গর্ভাবস্থায় পানি আগে ভেঙে গেলে (Premature Rupture of Membrane – PROM)-

অনেক সময় গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা ৩৭ সপ্তাহের আগেই হয়ে যায়, যাকে বলা হয় প্রি-ম্যাচিউর রাপচার অব মেমব্রেন। এটি বিপজ্জনক হতে পারে কারণ—

  • শিশুর ফুসফুস সম্পূর্ণ বিকশিত না-ও হতে পারে
  • সংক্রমণ বা ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়
  • আগে প্রসব শুরু হতে পারে

এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গার পর ডাক্তারের করণীয়-

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তার সাধারণত নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেন—

  • পরীক্ষা: যোনি পরীক্ষা করে দেখা হয় পানি সত্যিই ভেঙেছে কিনা।
  • শিশুর হার্টবিট মনিটরিং: শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
  • সংক্রমণ পরীক্ষা: সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা করা হয়।
  • প্রসব উদ্দীপক ওষুধ: পানি ভাঙার পর যদি ব্যথা না আসে, তবে প্রসব ত্বরান্বিত করতে ওষুধ দেওয়া হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা এবং প্রসবের সম্পর্ক-

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা মানেই প্রসবের সময় খুব কাছাকাছি। কিছু ক্ষেত্রে পানি ভাঙার পরই ব্যথা শুরু হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পর ব্যথা আসে।

তবে যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রসব না হয়, সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক সময়ে ডেলিভারি করানোই নিরাপদ।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা প্রতিরোধে করণীয়-

যদিও এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, কিছু সতর্কতা গ্রহণ করলে ঝুঁকি কমানো যায়—

  • পর্যাপ্ত পানি পান করুন
  • ধূমপান বা অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকুন
  • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
  • ভারী কিছু তোলা বা অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন
  • নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চেকআপ করুন
  • ইনফেকশন বা সাদা স্রাব হলে দ্রুত চিকিৎসা নিন

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা: মিথ ও বাস্তবতা-

মিথ ১: পানি ভাঙলে সবসময় ব্যথা হয়।
বাস্তবতা: অনেক সময় পানি ভাঙলেও কোনো ব্যথা হয় না।

মিথ ২: পানি ভাঙা মানেই সাথে সাথে ডেলিভারি।
বাস্তবতা: অনেক সময় ১২-২৪ ঘণ্টা পর প্রসব শুরু হয়।

মিথ ৩: পানি ভাঙলে হাঁটা-চলা করা যায় না।
বাস্তবতা: ডাক্তার না বললে হালকা নড়াচড়া করা যায়, তবে অযথা পরিশ্রম নয়।

উপসংহার-

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা একটি প্রাকৃতিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা জানিয়ে দেয়—আপনার প্রসবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তবে এটি কখনও আগে ঘটলে বিপজ্জনক হতে পারে। তাই পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সময় নষ্ট না করে ডাক্তারের কাছে যান। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে মা ও শিশু উভয়েই থাকবে নিরাপদ ও সুস্থ।

গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় পানি ভাঙ্গা কেমন অনুভূত হয়?
উত্তর: সাধারণত হঠাৎ করে তরল বের হয়ে যায় বা ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে থাকে। এটি প্রস্রাবের মতো নয়, বরং ঠান্ডা ও গন্ধহীন হয়।

প্রশ্ন ২: পানি ভাঙলে কি ব্যথা হয়?
উত্তর: বেশিরভাগ সময় ব্যথা হয় না। তবে প্রসব শুরু হলে ব্যথা আসতে পারে।

প্রশ্ন ৩: পানি ভাঙার পর কত সময়ের মধ্যে ডেলিভারি হয়?
উত্তর: সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রসব হয়। যদি না হয়, ডাক্তার ওষুধ দিয়ে প্রসব ত্বরান্বিত করতে পারেন।

প্রশ্ন ৪: পানি ভাঙার পর হাঁটাচলা করা ঠিক কি না?
উত্তর: হালকা হাঁটা করা যায়, তবে ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া বা পরিশ্রম করা উচিত নয়।

প্রশ্ন ৫: পানি আগে ভাঙলে কি শিশু বিপদে পড়তে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, আগে পানি ভাঙলে ইনফেকশন ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে, তাই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top